14/07/2025
রাতের খাবার খেয়ে খানিকক্ষণ বিছানায় মোড়ামুড়ি করছিলাম। হঠাৎ স্ত্রী ঘরে ঢুকে তার মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,'এই, এইটা তোমার কলেজ ফ্রেন্ড রিক্তা না? যার প্রেমে ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গিয়েছিলে?'
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। স্ক্রিনে একটা হাস্যজ্বল মেয়ের ছবি ভেসে আছে।
বললাম,'ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হতে যাব কোন দুঃখে? ভালো লাগতো বলে প্রপোজ করেছিলাম। তার ভালো লাগেনি, তাই সে একসেপ্ট করেনি।'
'হ্যাঁ, হয়েছে। এখনো তো মেয়েটার ফ্রেন্ড লিস্টে আছো!'
'হ্যাঁ। কয়েক মাস আগে সে নিজেই রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিল। কলেজ ফ্রেন্ড হিসেবে একসেপ্ট করেছি। আর তাছাড়া এখন তো আমাদের দুজনারই বিয়ে হয়ে গেছে, সংসার করছি দুজনেই। তা এতদিন পর হঠাৎ তাকে নিয়ে পড়লে কেন?'
'পড়িনি। টাইমলাইন স্ক্রোল করতে গিয়ে সাজেস্টেড ফ্রেন্ডে ওর প্রোফাইল এলো। তোমার মিউচুয়াল দেখে ঢুকছিলাম। পরে দেখি, এ তো তোমার সেই কলেজের ক্রাশ! মেয়েটা মনে হয় দেশের বাইরে থাকে, তাই না?'
'হ্যাঁ। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে থাকে।"
স্ত্রী হালকা হেসে কাঁটা গলায় বলল,'কি কপাল মেয়েটার! ওর টাইমলাইন দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। স্বামী, পরিবার নিয়ে বেশ সুখেই আছে। আর আমার কপাল দ্যাখো, বাবা দেখেশুনে একটা বান্দরের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে! দেশের বাইরে তো দূরের কথা, আজ অবধি সাজেক কেমন, সেটাও নিজের চোখে দেখা হলো না!'
'বান্দর দেখেই তো মুক্তোর মালা ঝুলিয়ে দিয়েছে, বলেই হালকা হাসলাম।
স্ত্রী একরাশ অভিমান নিয়ে ঘরের লাইট বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। আমিও আর তেমন কিছু বললাম না। বিষয়টা আর ঘাঁটানো উচিৎ মনে হলো না।
মায়ার অভিমান করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। প্রতিটা মেয়েরই স্বামীর কাছে কিছু চাওয়া থাকে, কিছু স্বপ্ন থাকে। বিয়ের এই দুই বছরে মায়াকে নিয়ে কোথাও তেমনভাবে ঘুরতে যেতে পারিনি। ইচ্ছা যে করে না, তা নয়। খুব ইচ্ছা করে, কিন্তু সেই ইচ্ছেকে ছুঁতে গেলে বাস্তবের শেকলে টান পড়ে। আমি অল্প বেতনের চাকরি করি। মাস শেষে যা পাই, তার প্রায় সবটাই খরচ হয়ে যায় সংসারে। তবে ইচ্ছেটা জমিয়ে রাখছি,একদিন অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে মায়ার সেই ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্নটা পূরণ করবো।
রিক্তা আমার কলেজ ফ্রেন্ড। কলেজ জীবনে এই একজনকেই আমার মনে ধরেছিলো। তাই কিছুদিন পর মনের কথা চেপে রাখতে না পেরে 'ভালোবাসি' বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার মুখে 'ভালোবাসি' শুনে রিক্তা সেদিন বলেছিলো,' দ্যাখো আমার পক্ষে এসব প্রেম ভালোবাসায় জড়ানো সম্ভব নয়। আমার পরিবার এসব পছন্দ করেনা-আর আমিও চাই না পরিবারের অমতে গিয়ে এসবে জড়াতে। আমি বিয়ে করলে আমার পরিবারের পছন্দতেই বিয়ে করবো।'
সেদিনের পর থেকে আমরা দুজনও আর পাঁচজনার মতো শুধুই বন্ধু। কলেজ শেষ হওয়ার পর রিক্তার সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। বহুদিন পর, মাস কয়েক আগের কথা,হঠাৎ একদিন দেখি, রিক্তা আমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছে। প্রথমদিন দু-চার কথা হলেও, তারপর থেকে আর তেমন কোনো আলাপ হয়নি আমাদের।
রিক্তার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধু তালিকায় থাকা বাকিদের মতোই,বিশেষ কোনো দিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে ছোট্ট একটু বার্তা, মাঝেমধ্যে কোনো ছবিতে এক-আধটা রিয়্যাকশন, ব্যস… এই পর্যন্তই আমাদের বন্ধুত্বের সীমারেখা।
রিক্তার প্রতিটা পোস্ট আমার টাইমলাইনে আসে। আমি চুপচাপ দেখি আর ভাবি; মেয়েটা কী ভাগ্যবতী! সত্যিই, এমন রাজকপাল ক’জনের কপালে জোটে? মাঝে মাঝে মনে হয়, সেদিন আমার প্রপোজালটা যদি রিক্তা একসেপ্ট করতো, তবে হয়তো মায়ার মত রাতদিন আপসোস করে কাটাতে হতো তাকেও।
এরপর কেটে গেছে বেশ কয়েকটি মাস। হঠাৎ একদিন রিক্তার মেসেজ এল,'আমি আর শাহিদ দেশে ফিরছি আগামীকাল। ভাবিকে নিয়ে একদিন এসো আমাদের বাসায়। সবাই মিলে অনেক আড্ডা হবে।'
মেসেজটা দেখেই থমকে গেলাম। কোনো উত্তর দিলাম না।
রিক্তার স্বামী একজন বড়লোক, বিলাসবহুল জীবনযাপন তাদের। দামি সাজসজ্জা, রিক্তার গায়ে ঝকঝকে গয়না,এসব দেখে মায়ার মনে হয়তো আবার আফসোস জাগবে, তার চোখের কোণে জমে উঠবে না বলা অভিমান।
তাই না যাওয়াই ভালো ভেবেছিলাম।
কিন্তু, যাকে নিয়ে ভয়, সে নিজেই রিক্তাকে দেশে আসতে দেখে তার সাথে কথা বলে দাওয়াত গ্রহণ করে নিলো।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, ঈদের সময় মায়ার জন্য কেনা জামদানী শাড়ি টা পরে সেজেগুজে বসে আছে।
আমায় দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,'এসেছো তুমি? এখন চট করে রেডি হয়ে নাও।'
আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলে মায়া বললো,' তোমার লন্ডনী বান্ধবী আছে না? তার বাসায় যাব। সে আমাদেরকে তার বাসায় আজ রাতে ডিনারের দাওয়াত করেছে। এখন রেডি হয়ে নাও তো।'
'আমি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,'রিক্তাকে তুমি কোথায় পেলে? কথা হয় তোমার সঙ্গে?'
মায়া হেসে বলল,'এতদিন তো হয়নি। কিন্তু দেশে ফিরেছে শুনেই ওকে একটা মেসেজ দিয়েছিলাম। তোমার নাম বলতেই অনেক কথা হলো আমাদের। আজ সকালে সে নিজেই মেসেজ করে বলেছে, আজ রাতে আমাদের দুজনের ডিনার ওদের বাসায়। আমরা যেন অবশ্যই যাই। বার বার করে বললো,না গেলে কেমন দেখায়? তোমার আর কাপড় ছাড়ার দরকার নেই আর,অফিসের কাপড়েই বেশি সুন্দর লাগে তোমাকে। একটা সাহেবিয়ানা ভাব আছে তুমি গিয়ে বরং হাত-মুখ ধুয়ে আসো জলদি, তারপর রওনা দিবো।'
'আজকে না গেলে হয় না? শরীরটা অনেক ক্লান্ত।'
'আমি তো কিছু রান্না করিনি আজ, রাতের খাবার সেখানেই খাবো বলে। গাড়িতে চেপে যাবে তো ক্লান্ত হলেই বা কি? ফ্রেশ হয়ে আসো তো জলদি।'
এই মেয়েটাকে নিয়ে যে পড়েছি এক বিপদে! মুখে একবার কিছু বললে, না করা অবধি রেহাই নেই। অগত্যা, ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লাম মায়াকে নিয়ে।
রাত তখন সবে শুরু হয়েছে। রিক্তারা ধানমন্ডিতে থাকে। বেশ বড়োলোকি ব্যাপার স্যাপার। না জানি দাওয়াতে গিয়ে আবার কোন গোলমাল লাগিয়ে বসে আমার বউ।
প্রায় একঘন্টা পর রিক্তাদের বাসার সামনে গিয়ে পৌঁছালাম। বারো তলা এপার্টমেন্ট। আলিশান বাড়ি। রিক্তারা ছয় তলায় থাকে। বাসায় নিচ থেকে মায়া-রিক্তার নাম্বার কল দেওয়ার কিছুক্ষণের ভিতরে মস্তবড় গেইট খুলে একটা সদা হাস্যজ্বল নারী বেরিয়ে এলো। বেশভূষায় কেমন একটা সাদামাটা ভাব। ফেসবুকের ছবির সাথে বাস্তবের রিক্তার যেন বিস্তর ফারাক।
আমাদের দুজনকে দেখে রিক্তা হাসি মুখে এগিয়ে এসে আমাদেরকে সঙ্গে করে ভিতরে নিয়ে গেলো। আমি চুপচাপ তাদেরকে অনুসরণ করে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
বেশ ছিমছাম আর গোছানো রিক্তাদের বাসাটা।
দেয়ালের এদিক-সেদিক ঝুলছে tasteful সব পেইন্টিং, চারপাশে দামী ফার্নিচার দিয়ে ঠাঁসা পুরো ঘরটা।
মায়া হাঁ করে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। যেন টিনের ঝুপড়ি পেরিয়ে সোজা রাজপ্রাসাদে এসে পড়েছে সে!
রিক্তা আমাদের ড্রেসিংরুমের সোফায় বসতে দিলো।
আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে বললাম,' তোমার হাসব্যান্ডকে দেখছি না তো, কোথায় উনি?'
কথাটা বলতেই রিক্তার মুখের হাসিটা খানিকটা মলিন হয়ে গেলো। জোর করে হাসবার চেষ্টা করে বললো,ও… একটু বাইরে গিয়েছে। চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যেই।
তোমাদের কথা বলো, কতদিন পর দেখা হলো তাই না? তুমি তো অনেক বদলে গিয়েছো। মায়া ভাবিও দেখতে মাশা-আল্লাহ!'
আমি হেসে বললাম,'তুমিও বদলে গিয়েছো। চেহারার এমন অবস্থা কেন তোমার? ছবিতে যে হাস্যজ্বল মুখটা দেখতাম, বাস্তবে সেটা যেন নেই। কোনো সমস্যা হয়েছে? চাইলে আমাদের বলতে পারো।'
রিক্তা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো,'না, তেমন কিছু না। আবহাওয়া বদলের কারণে হয়তো এমন দেখাচ্ছে। আচ্ছা, তোমরা বসো। আমি খাবার রেডি করি।'
বললাম',তোমার হাসব্যান্ড আসবেনা? ও এলে একসাথে খাব।'
'তার আসার ঠিকঠিকানা নেই। দেশে ফেরার পর থেকে কোথায় কোথায় ঘুরে কে জানে। রোজ রাত করে বাসায় ফেরে। ততক্ষণ কি তোমাদের খালি মুখে বসিয়ে রাখবো আমি?'
বলেই রিক্তা উঠে চলে গেলো রান্নাঘরের দিকে।
মায়া আমার হাতে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বললো,'ইশ! কি সুন্দর বাড়িটা! মেয়েটার আসলেই রাজকপাল!'
কিছুক্ষণ পর রিক্তা খাবার রেডি করে ডাক দিলে দুজনেই উঠে গেলাম। নানান পদের দেশি-বিদেশীয় খাবার দিয়ে খাবারের টেবিল সাজানো!
মায়া তো ঠোঁট কেটে বলেই ফেললো,' এতসব আমাদের জন্য করেছো!'
রিক্তা মৃদু হেসে বললো,' হ্যাঁ। সব তোমাদের জন্যই করেছি। এক এক করে খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।'
মায়া খুশিতে গদগদ হয়ে এক এক করে সব পদ চেখে দেখতে লাগলো। কিন্তু আমি শুধু অল্প ভাত আর কয়েক পিস মাংস তুলে নিয়ে প্লেটে নাড়াচাড়া করতে লাগলাম।
এখানে আসার পর থেকে রিক্তাকে কেমন যেন অচেনা লাগছে। ফেসবুকের রিক্তা আর বাস্তবের রিক্তা,দুজন যেন এক নয়। সবকিছু কেমন যেন সাজানো, অভিনয় মনে হচ্ছে।
ডিনার শেষ করে আরও কিছুক্ষণ বসে আমরা তিনজন গল্পগুজব করছিলাম। কথার এক পর্যায়ে রিক্তার হাসব্যান্ড এসে উপস্থিত হলো। মদের নেশায় টলতে টলতে ঘরে ঢুকে রিক্তাকে একটা বিশ্রী শব্দে ডাক দিতেই রিক্তা আমাদেরকে বসতে বলে ছুটে গেলো সেদিকে।
আমি আর মায়া দুজনেই হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। ভিতরে রিক্তা আর তার হাসব্যান্ডের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে গেছে। রিক্তা তাকে থামানোর চেষ্টা করলেও, তার নেশাগ্রস্ত স্বামী অনর্গল আবোলতাবোল বলে যাচ্ছে।
আর থাকতে ইচ্ছা করলো না। মায়াকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম রিক্তাদের বাসা থেকে। পুরোটা পথজুড়ে মায়া একবারও রিক্তার 'সুখ' নিয়ে কিছু বললো না আর।
বাসায় ফিরে দেখি রিক্তার একটা টেক্সট এসেছে,'তোমার স্ত্রী আমার সুখ দেখতে চেয়েছিলো? এটাই আমার আসল সুখ। টাইমলাইনে যেগুলো দেখো, সেগুলো নিছক তোমাদের চোখে সুখী হওয়ার অভিনয়, যাতে অন্তত নিজেকে একটু সান্ত্বনা দিতে পারি।'
টেক্সটের কোনো জবাব দিলাম না। মায়াকে বললাম,
'মানুষ হিসাবে আমরা বড়ই অদ্ভুত কিসিমের জানো তো। সমাজে রিক্তাদের মত বহু মানুষ আছে যারা ভিতরে এক আকাশ দুঃখকে চেপে রেখে প্রতিনিয়ত সবার চোখে নিজেকে সুখী দেখানোর জন্য আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে।
আর আমরাও তাদেরকে দেখে আপসোস করে বলি, ইশ আমার জীবনটা কেন ওদের মত হলো না।
আসলে খালি চোখে আমরা যা দেখি সেগুলো সবসময় সত্যি হয় না। মূদ্রার এপিঠে আলো পড়লেও ওপিঠের অসংখ্য ক্ষতগুলো তারা তাদের মিথ্যে অভিনয় দিয়ে ঢেকে রাখতে চায়। বাইরে থেকে যদি কারও প্রকৃত সুখটা অনুভব করার ক্ষমতা থাকতো, তাহলে হয়তো অন্যের জীবন দেখে এত হায়হাপিত্যেশ করতে হতো না।
সবটাই আসলে একধরনের সাজানো মিথ্যে,একটা সো-অফ, যার ভেতরে অনেক শূন্যতা আর আলেয়া লুকানো থাকে।'