23/10/2025
#এমভি_সালাউদ্দিন_০২
✪নৌযানের নাম:- এমভি সালাউদ্দিন ০২
✪রুট:- ঢাকা-রাংগাবালী-কালাইয়া-ঢাকা
✪নেভিগেশন:- মেসার্স এস আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স
✪রেজিষ্ট্রেশন নম্বর:- পাওয়া যায় নি
✪দূর্ঘটনার সময়কাল:- ৩ রা মে, ২০০২। রাত ০৯ টা ৩০ মিনিট।
✪দূর্ঘটনার স্থান:- চাঁদপুর ষাটনল
সেদিন রাতটি ছিল অন্যরকম। ৩ মে, ২০০২। ঢাকার সদরঘাটে, নদীর তীরে, মানুষজনের হালকা আড্ডা, লঞ্চের উঁচু শব্দ আর পানির ছটফট। সব মিলিয়ে এক স্বাভাবিক যাত্রার পরিবেশ। এমভি সালাউদ্দিন-২ লঞ্চটি তিনতলাবিশিষ্ট, ধারণক্ষমতা প্রায় ৪৫৬ জন। কিন্তু জানা যায় যে সেইদিন সেখানে উঠেছিল প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ মানুষ। এত মানুষ নিয়ে সালাউদ্দিন ০২ রাংগাবালীর উদ্দেশ্যে ঢাকা সদরঘাট ত্যাগ করে।
ছোট ছোট শিশুরা বাবার কোলে, মায়ের হাত ধরে। কেউ বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে মগ্ন, কেউ আবার জীবনের নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কেউ ব্যবসায়ের কাজে যাচ্ছিল, কেউ হয়তো নতুন আশা নিয়ে পরিবারকে খুশি করার পরিকল্পনা করছিল। কেউ জানত না যে, সেই ভ্রমনের রাতটি তাদের জীবনের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো অধ্যায় হয়ে যাবে।
রাত তখন ৯ টার আশেপাশে। আকাশে কালো মেঘ জমে গেল। হালকা বৃষ্টি শুরু হলো। বাতাসের তীব্রতা বেড়ে গেল। নদী উত্তাল হয়ে উঠল। ঢেউগুলো লঞ্চের দিকে আঘাত করতে লাগল। প্রথমে কেউ ভয় পেল না। ভিড় ছিল অনেক। কেউ ছাদে উঠে দূরে তাকাল, কেউ পানি ছুঁয়ে দেখল ঢেউ কত গভীর। তখনও কেউ ভাবেনি যে, শীঘ্রই লঞ্চ তাদের ওপর ভেঙে পড়বে।
সালাউদ্দিন ০২ নারায়নগঞ্জ ঘাট ছেড়ে মুন্সিগঞ্জ পেরিয়ে ষাটনলের কাছাকাছি।বাতাসের তীব্রতায় বেসামাল অবস্থায় দুলছে। মাস্টারের চেস্টা হার মেনে যেতে লাগলো বাতাসের গতির কাছে। তখনই আসে ফেন্ডার বরাবর এক ঢেউ। ঢেউয়ে লঞ্চটি দুলতে শুরু করল। ছোটদের কান্না, বৃদ্ধদের চিৎকার, যুবকদের আতঙ্ক—সব মিলিয়ে নদী যেন এক বিশাল কাঁদার জায়গা হয়ে উঠল। লঞ্চের একটি পাশ হঠাৎ ভেঙে গেল। কেউ চিৎকার করছে, কেউ হাত বাড়িয়ে সাহায্য চাইছে। ঢেউয়ের তীব্র গতিতে অনেকেই ডুবে গেল। রাতের অন্ধকারে কারও চোখে আর কোনও দৃষ্টি নেই। শুধু জীবন রক্ষার জন্য এক বীরত্বপূর্ণ লড়াই।
রাতের অন্ধকারের সঙ্গে নদীর স্রোত সব মিলিয়ে মানুষের জীবনকে ঘিরে ধরল। কেউ বাঁচার চেষ্টা করল, কেউ নিজের সন্তানকে বাঁচানোর জন্য লড়ল। ঢেউয়ে ভেসে যাচ্ছিল জিনিসপত্র, জীবনের ছোট ছোট স্বপ্ন। কেউ বাবার হাত ধরে, কেউ মায়ের কোলে বাঁচার জন্য লড়ল। কেউ নদীর গহীনে হারিয়ে গেল।
এ রাতের পর, চাঁদপুরের ষাটনল এলাকা নদীর তীরে দাঁড়ানো মানুষদের জন্য জন্ম দিলো এক অচেনা শুন্যতার। পরিবারগুলো শুধু আর্তনাদ করছিল, “আমাদের সন্তান কোথায়? আমাদের স্বামী কোথায়?” নদী ছিলো নিস্তব্ধ, কিন্তু তার ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কষ্ট, কান্না, ভয়।
উদ্ধার অভিযান শুরু হয়েছিল রাতেই। স্থানীয় জেলেরা, নৌবাহিনী, উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম এবং কোস্টগার্ড সবাই নদীর গভীরে ঝাঁপ দিয়ে সাহায্যের চেষ্টা করল। কিন্তু নদীর প্রবল স্রোত, গভীরতা, অন্ধকার সব মিলিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম ছিল এক মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই। অনেক মৃতদেহ ভেসে উঠল, অনেক নিখোঁজ রয়ে গেল।
যারা বেঁচে গেল, তারা বেচে থেকেও মৃতপ্রায়। প্রিয়জন হারানো মা-বাবা, স্বামী হারানো স্ত্রী—সবাই এক অচেনা দুঃখে ডুবে গিয়েছিলো। কেউ হাসতে পারছিল না, কেউ কোনো স্বাভাবিক খাবার খেতে পারছিল না। এই দুর্ঘটনা শুধু সংখ্যায় নয়, হৃদয়ে গভীর ক্ষতি করেছে।
নদী আজও সেই রাতের আর্তনাদ বহন করে। বৃষ্টি নামলেই, রাত হলোই, কেউ নদীর পাড়ে তাকালেই মনে হয়, হয়তো কেউ এখনও চিৎকার করছে—“বাঁচাও… বাঁচাও।” নদী শুধু পানি নয়, এটি মানুষের জীবন, স্মৃতি, ক্ষতি এবং ইতিহাস বহন করে।
পরিবারগুলো হারিয়েছে সন্তান, স্বামী, বাবা, মা। মানুষদের মনে জন্ম দিয়েছে এক শূন্যতার যে শূন্যতা কখনও পূরণ হয় না। নদী, যা জীবন দেয়, সেই রাতে জীবন কেড়ে নিল। এই ক্ষতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক ও মানবিক দিক থেকেও বিপুল ক্ষতি।
যেখানে লঞ্চভর্তি যাত্রী সেখানে কারো বেচে না ফেরাটাই স্বাভাবিক। তবুও সরকারী হিসেবমতে ৩৬৩ জন যাত্রীর সলীল সমাধী হয়েছিলো সেখানেই।
যাদের বেশীসংখ্যকই ছিলো রাংগাবালী, বাউফল, কালাইয়া, নুরাইনপুর কালীশুরী ও দশমিনার যাত্রী।
এই ভয়াবহ দূর্ঘটনার পর নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয় এর তদন্ত কমিটির দায়িত্বে অবহেলার জন্য পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী, জরিপকার সহ ৪ কর্মকর্তাকে দায়ী করে। এছাড়া ডিজাইনমাফিক লঞ্চ নির্মান না করায় মালিককে ও অতিরিক্ত যাত্রীবহনের জন্য মাস্টারকে অভিযুক্ত করা হয়। মালিককে অভিযুক্ত ও মাস্টারকে চাকরীচ্যুত করা হলেও অন্যদের শাস্তি দেয়া হয় নি।
উদ্ধারকর্মীরা, স্থানীয় জেলেরা, নৌবাহিনী—সকলের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই বিপর্যয়ের দুঃখ সমানভাবে কমানো যায়নি। নদীর গভীরতা, ঝড়ো আবহাওয়া, অন্ধকার—সব মিলিয়ে এক প্রলয় সৃষ্টি করেছিল।
এমভি সালাউদ্দিন ০২ এ নিহত সকল যাত্রীদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি।
লিখনি:- খোন্দকার সানোয়ার হোসেন আকিক
বিশেষ দ্রস্টব্য - পোস্টটি কপি করলে তার জন্য একটা ক্রেডিট দেয়ার অনুরোধ থাকলো। ধন্যবাদ।।
ছবিসুত্র:- দৈনিক কালের কন্ঠ, যুগান্তর