15/02/2025
মেনি মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ ব্যবস্থাপনা
বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছের আবাসস্থল হিসেবে প্লাবনভূমি অন্যতম। কিন্তু মৎস্যসম্পদের উৎস এই প্লাবনভূমি হতে মৎস্য উৎপাদন আজ পানি দূষণ, কীটনাশক প্রয়োগ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মান, নির্বিচারে মৎস্য আহরণসহ জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে হুমকির সম্মুখীন। এসব কারণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মৎস্য প্রজাতির প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস হয়েছে। বিপন্ন হয়ে গেছে বাংলাদেশের ৬৪ প্রজাতির মাছ (আইইউসিএন ২০১৫)। বিপন্ন প্রজাতির এসব মাছের মধ্যে মেনি বা ভেদা অন্যতম। অত্যন্ত সুস্বাদু ও জনপ্রিয় এই মাছটি স্থানীয়ভাবে নন্দাই, ধ্যান্দা, নুইন্যা প্রভৃতি নামে পরিচিত। পূর্বে এই মাছটি আমাদের দেশে প্রাকৃতিক জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। ঈষৎ ধূসর ও কালচে বাদামী রঙের ডোরাকাটা ছোপ ছোপ বিন্যাসকৃত এই মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এর প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, সান্তাহার বগুড়ায় গবেষণার মাধ্যমে এর কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
মেনি বা ভেদা মাছের বৈশিষ্ট্য
✓ ঈষৎ ধূসর ও কালচে বাদামী রঙের ডোরাকাটা ছোপ ছোপ বিন্যাসকৃত
✓ বর্ষাকালে বিল, হাওর-বাঁওড়, নদী, প্লাবনভূমি এবং ধানক্ষেতে দেখা যায়।
✓ কর্দমাক্ত জলাশয় এদের বেশি পছন্দ
✓ আগাছা, কচুরিপানা, ডালপালা অধ্যুষিত জলাশয়ে থাকে
কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন
মেনি বা ভেদা মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদন কৌশল নিম্নে বর্ণনা করা হলো:
ব্রুড মাছ সংগ্রহ ও পরিচর্যা কৃত্রিম প্রজননের জন্য প্রাকৃতিক জলাশয় (বিল, প্লাবনভূমি, হাওর-বাঁওড়, নদী) হতে ভেদা মাছ সংগ্রহ করা যেতে পারে। এ মাছের প্রজননকাল এপ্রিল হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত। প্রজনন মৌসুমের পূর্বে ভেদা মাছ সংগ্রহ করে পুকুরে পরিচর্যার মাধ্যমে ব্রুড মাছ তৈরি করা হয়। নিম্নে ভেদা মাছের ব্রুড পরিচর্যার বিষয়সমূহ বর্ণনা করা হলো।
✓ প্রজনন মৌসুমের ৩-৪ মাস পূর্বে অর্থাৎ জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি মাসে প্রাকৃতিক উৎস হতে ভেদা মাছ সংগ্রহ করতে হবে।
✓ ব্রুড প্রতিপালন পুকুরের আয়তন ৮-১০ শতাংশ এবং গভীরতা ৩-৪ ফুট হলে ভালো।
✓ ব্রুড মাছের মজুদ পুকুর পরিমিত চুন ও সার (ইউরিয়া, টিএসপি ও কম্পোষ্ট) দিয়ে প্রস্তুত করতে হয়।
✓ পরিপক্ক ব্রুড মাছ তৈরির জন্য প্রতি শতাংশে ২৫-৩৫ গ্রাম ওজনের ভেদা মাছ ৭০-৮০ টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
✓ ভেদা মাছ যেহেতু জীবিত মাছ, চিংড়ি, জলজ পোকামাকড় ও জুওপ্লাংটন খেয়ে থাকে তাই পুকুরে এদের পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করতে হবে।
✓ এই পদ্ধতিতে ৩-৪ মাস পালনের পর ভেদা মাছ প্রজননক্ষম হয়ে থাকে।
প্রজননক্ষম মাছ সনাক্তকরণ
✓ পুরুষ মাছ স্ত্রী মাছের তুলনায় আকারে ছোট হয়ে থাকে।
✓ প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী মাছের পেট ডিমে ভর্তি থাকে বিধায় ফোলা দেখা যায় অন্যদিকে পুরুষ মাছ খানিকটা সরু ও পেট চ্যাপ্টা থাকে।
✓ প্রজনন মৌসুমে পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী মাছের দেহ উজ্জ্বল বর্ণ ধারণ করে।
মেনি বা ভেদা মাছ এপ্রিল হতে আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রজনন করে থাকে। নিম্নোক্ত পদ্ধতিতে এ মাছের কৃত্রিম প্রজনন করা হয়।
✓ সংগৃহীত পরিপক্ক ব্রুড (স্ত্রী ও পুরুষ) মাছকে ভাসমান জলজ উদ্ভিদপূর্ণ ও কাদাযুক্ত সিস্টার্ণে রাখা হয়।
✓ সিস্টার্নে অক্সিজেন নিশ্চিত করতে কৃত্রিম ঝর্ণা ব্যবহার করতে হয়।
✓ খাবার হিসাবে ছোট মাছ, কেঁচো ও মাছের রেণু পোনা সরবরাহ করা হয়।
✔ প্রায় ২০ দিন পর দেহের রঙ ও আকৃতি দেখে মাছের প্রজনন সক্ষমতা নিশ্চিত করা হয়।
✓ স্ত্রী ভেদা মাছের ক্ষেত্রে ২-৪ মিগ্রা,/কেজি ও পুরুষের ক্ষেত্রে ১-২ মিগ্রা./কেজি হারে পিজি বক্ষ পাখনার নীচে মাংসল অংশে ইনজেকশন দিতে হয়।
✓ পুরুষ ও স্ত্রী মাছকে ১:২ অনুপাতে হাপায় স্থানান্তর করা হয়।
✓ হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করার ৭-৮ ঘণ্টা পর মাছ প্রাকৃতিক প্রজননের মাধ্যমে ডিম দিয়ে থাকে।
✓ নিষিক্ত ডিম ফুটে ২০-২৪ ঘন্টা পর রেণু পোনা বের হয়।
✓ রেনু পোনার বয়স ৩০-৩৬ ঘন্টা হলে সিদ্ধ ডিমের কুসুমের দ্রবণ দিনে ৪ বার খাবার হিসেবে দিতে হয়।
✓ হাপাতে রেণু পোনাকে এভাবে ৪-৫ দিন রাখতে হয়।
✓ হাপায় লালাকালে ৬ষ্ঠ দিনে রেণু পোনা নার্সারি পুকুরে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নিতে হবে।
নার্সারি পুকুরে পোনা লালন
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
✓ নার্সারি পুকুরের আয়তন ১৫-২০ শতাংশ এবং গভীরতা ১-১.৫ মিটার হলে ভালো হয়।
✓ পুকুরের পানি শুকিয়ে অবাঞ্চিত মাছ ও প্রাণি দূর করতে হবে।
✓ পুকুরের চারপাশে নাইলনের জাল দিয়ে ৩-৪ ফুট উচু করে বেষ্টনী দিতে হবে। যাতে ব্যাঙ বা সাপ পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে।
✓ শুকনো পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন দিয়ে ভালোভাবে মই দিয়ে সমান করতে হবে।
✓ চুন প্রয়োগের ২-৩ দিন পর পুকুর ৩-৪ ফুট বিশুদ্ধ পানি দিয়ে পূর্ণ করে শতাংশে ৮-১০ কেজি জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
✓ চুন প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর প্রাকৃতিক খাদ্য জন্মানোর জন্য শতাংশে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ৫০ গ্রাম টিএসপি সার প্রয়োগ করতে হবে।
✓ রেণু পোনা ছাড়ার ২৪ ঘন্টা আগে শতাংশ প্রতি ১০ মিলি, (২-৩ ফুট গভীরতার জন্য) সুমিথিয়ন অল্প পানিতে মিশিয়ে সমস্ত পুকুরে ছিটিয়ে দিতে হবে।
পোনা মজুদ ✓ প্রস্তুতকৃত পুকুরে ৪-৫ দিন বয়সের রেণু পোনা শতাংশে ২০,০০০-২৫,০০০ টি হারে মজুদ করা যেতে পারে।
✓ রেণু ছাড়ার পর প্রতি শতাংশে ১-২টি সিদ্ধ ডিম সকাল, দুপুর ও বিকাল এভাবে ৩ দিন পর্যন্ত প্রয়োগ করতে হবে।
✓ খাবার হিসেবে ১৫-২০ দিন পর প্রতি শতাংশে ৫০ গ্রাম কার্প জাতীয় মাছের রেণু দিতে হবে।
✓ অতঃপর প্রতি শতাংশে ১০০ গ্রাম খৈল ও ১০০ গ্রাম আটা দিতে হবে।
✓ মেনি মাছ যেহেতু জীবিত মাছ, চিংড়ি, জলজ পোকা মাকড় ও জুওপ্লাংটন খেয়ে থাকে তাই পুকুরে অন্যান্য মাছের রেণু ও জুওপ্লাংটন পর্যাপ্ত রাখতে হবে।
✓ উল্লিখিত খাবারের পাশাপাশি প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য পুকুরে পরিমানমত জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করতে হবে।
✓ রেনু পোনা ছাড়ার ৩০ দিন পর চারা পোনায় পরিণত হয়, অর্থাৎ পোনার ওজন গড়ে ৪-৫ গ্রাম হলে চারা পুকুরে স্থানান্তর করতে হবে।
মেনি মাছের চাষ ব্যবস্থাপনা
পুকুর নির্বাচন ও প্রস্তুতি
✔ চাষের জন্য ২৫-৩০ শতাংশ আয়তনের পুকুর নির্বাচন করতে হবে, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৬-৭ মাস ৩ ফুট পানি থাকে
✓ পুকুরের পাড় মেরামত ও জলজ আগাছা পরিস্কার করতে হবে
✓ পুকুর শুকিয়ে অবাঞ্চিত মাছ ও প্রাণি দূর করতে হবে
✓ পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন ও ১০ কেজি হারে জৈব সার ছিটিয়ে দিতে হবে।
✔ প্রাকৃতিক খাদ্য তৈরির জন্য ৫-৭ দিন পর পুকুরে প্রতি শতাংশে ২০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম টিএসপি প্রয়োগ করতে হবে।
✓ রাক্ষুসে ও ক্ষতিকর প্রাণি যেন পুকুরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য ৩-৪ ফুট উঁচু করে নাইলন জাল দিয়ে পুকুরের চারপাশ ঘিরে দিতে হবে।
পোনা সংগ্রহ ও মজুদ
✓ মেনি মাছের পোনা সংবেদনশীল হওয়ায় অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পোনা সংগ্রহ ও মজুদ করতে হয়।
✓ পোনা মজুদের পূর্বে পোনাকে মজুদকৃত পুকুরের পানির সাথে ভালোভাবে কন্ডিশনিং করে তারপর ছাড়তে হবে।
✓ প্রতি শতাংশে ৭০০ টি ৪-৫ গ্রাম ওজনের মেনি মাছের পোনা মজুদ করা যেতে পারে
✓ মেনি মাছের সাথে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০ গ্রাম কার্প জাতীয় মাছের ধানী পোনা ছাড়তে হবে
✔ মেনি মাছের স্বভোজী বৈশিষ্ট্য থাকায় এক পুকুরে একই সাইজের পোনা ছাড়তে হবে, অন্যথায় বড় মাছ ছোট গুলোকে খেয়ে ফেলবে।
ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যা
✓ মজুদের দিন থেকে প্রাকৃতিক খাবারের পাশাপাশি পোনার দৈহিক ওজনের ২০০ ৫% হারে দিনে দুই বার ৩৫-৪০% আমিষ সমৃদ্ধ সম্পূরক খাবার সরবরাহ করতে হবে
✓ মেনি মাছ যেহেতু জীবিত মাছ, পোকা-মাকড়, জুওপ্লাংটন প্রভৃতি খেয়ে থাকে, তাই প্রাকৃতিক খাবার উৎপাদনের জন্য পুকুরে নিয়মিত সার প্রয়োগ করতে হবে
✔ মেনি পোনার বাড়তি খাবার হিসেবে পুকুরে প্রতি শতাংশে ৫০-৬০ গ্রাম কাপ জাতীয় মাছের রেনু পোনা ছাড়তে হবে
✓ প্রতি ১০-১৫ দিন পরপর জাল টেনে মাছের বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করে খাবারের পরিমান নির্ধারণ করতে হবে।
✓ চাষকালীন যদি মাছের আকার ছোট-বড় হয়ে যায় তবে বড় মাছকে আলাদা করে ফেলতে হবে
✓ মেনি মাছ সাধারণত পুকুরের নীচের স্তরে থাকে তাই ফাইটোপ্লাংটনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য মাছ যেমন রুই, কাতলা ও সরপুঁটির সাথে মিশ্র চাষ করা যেতে পারে
✓ পানির গুণাগুণ ঠিক রাখার জন্য পোনা মজুদের ৩০ দিন পর পর চুন ও সার প্রয়োগ করতে হবে
✓ প্রয়োজনে বাহির হতে পুকুরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার ব্যবস্থা নিতে হবে।
মাছ আহরণ ও উৎপাদন
উল্লিখিত পদ্ধতিতে মেনি মাছ চাষ করলে ৪-৫ মাসের মধ্যে ৫০-৬০ গ্রাম ওজনের হবে। এ সময় জাল টেনে ও পুকুরের সমস্ত পানি শুকিয়ে মাছ ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।
পরামর্শ
✓ সুস্থ-সবল মাছ সংগ্রহ করে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে ব্রুড মাছ তৈরি করতে হবে
✓ খাবারের জন্য জীবিত মাছ ও জলজ পোকামাকড়ের পাশাপাশি পুকুরে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক খাবার তৈরির জন্য নিয়মিত সার ও জৈব সার প্রয়োগ করতে হবে
✓ যেহেতু মেনি মাছের রেনু মারা যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে, তাই অত্যন্ত সতর্কতার সহিত রেনুপোনার নার্সারি ব্যবস্থাপনা করতে হবে
✓ পুকুরে খাবারের উপস্থিতি ও পানির গুণাগুণ ঠিক আছে কিনা তা ১৫ দিন পরপর পর্যবেক্ষণ করতে হবে।