14/05/2025
|| ভেজ মাঞ্চুরিয়ান।।
"শোনো আমি পরিস্কার একটা কথা বলে দিচ্ছি ঐ চিনা-মিনা খাবার আমার বাড়িতে হবে না। তুমি অন্য জাতীর ছেলেকে বিয়ে করছ আমি মেনে নিয়েছি , তোমার ইচ্ছে মতো সবকিছু তুমি চাপিয়ে দেবে নাকি!আমরা বাঙালি , আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য আছে, সাবেকিয়ানা আছে এসবের বাইরে গিয়ে তোমাদের এই পাশ্চাত্য আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসাতে আমি পারব না।"
-"তাহলে জেনে রেখো আমিও তোমার মেয়ে, তুমি আমায় যে আদর্শে বড়ো করেছ তাতে আমার যে বিচার বুদ্ধি তৈরি হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে এই গোঁড়ামি আমিও মেনে নেব না। ", বলেই মুখ ঘুরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল রাজনন্দিনী।
নিচের বড় বারান্দায় পাইচারি করতে করতে ছোট ভগিনীপতীকে উদ্দেশ্য করে বললেন চন্দনবাবু,
-আচ্ছা বাংলায় কি আইটেম কম পড়েছে! এত লাফালাফি কিসের এই মাঞ্চুরিয়ান নিয়ে বলোতো? তুমি কখনো মাঞ্চুরিয়ান খেয়েছ?
-হ্যাঁ খেয়েছি, অসম্ভব ভালো খেতে। আসলে জামাইবাবু কিছু আইটেমের সঙ্গে কিছু আইটেম ভালো যায়।
-থামো তো ঐ তো ডালের বড়ার মতো জিনিস । বিয়েবাড়িতে কেউ ঐসব খাওয়ায় মানুষকে আমাদের একটা আভিজাত্য নেই?
-জামাইবাবু মাঞ্চুরিয়ানের অভিজাত্য কিন্তু কম নয়।
-কিসের আভিজাত্য! চাইনিজ প্রোডাক্টের আবার আভিজাত্য!
-আচ্ছা আপনার ১৯৭৫ সালটা মনে আছে?
-হ্যাঁ থাকবে না ! বঙ্গবন্ধুর হত্যা, জরুরী অবস্থার শুরু ।সে কি অবস্থা! ইন্দিরা গান্ধীকে সবাই তখন সমালোচনা করেছিল।
-হ্যাঁ আর MCA-এর ওয়াংখেড় স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্ট ম্যাচ!
-রাইট India vs Westindies। হেরে যাওয়াগুলো মনে বড্ড গেঁথে যায় গো।
-তারপর ঐ স্টেডিয়ামেই রবীশাস্ত্রীর এক ওভারে ছ'টা ছক্কা।
-হ্যাঁ বরোদার সাথে রঞ্জি ট্রফি।
-জানেন এই মাঞ্চুরিয়ানের জন্ম কিন্তু মুম্বাই ক্রিকেট ক্লাবে।
-বলো কি! এটা চায়নার নয়!
-নেলসন ওয়াং নামে একটি চিনা বংশোদ্ভূত ছেলে কিন্তু তার জন্ম ভারতের মাটিতেই। ওরই বানানো এটা। ভারতবর্ষকে তো 'মহামিলনের ক্ষেত্র' বলা হয় এইজন্যই আর বাংলা ভাষার সঙ্গে ভারতবর্ষের সবথেকে বড় মিলও কিন্তু এখানেই , সে যে সব কিছু অ্যাডপ্ট করে নেয়। সেই জন্য দেখুন আমরা এখন প্যান্ট শার্ট পড়ি, রেলগাড়ি চড়ি, এমনকি যে বাংলায় কথা বলি তার মধ্যে কত ভাষা মিলে মিশে একাকার হয়েছে, সেরকম রান্নাতেও বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রভাব পড়েছে, আমরা কিন্তু সেই সব কিছুকেই বুকে করে আগলেছি।
-বিকজ্ উই আর লভ টু লিভ ইন নস্টালজিয়া।
-এক্সাক্টলি। সেরকমই ভারতে জন্মানো নেলসন ওয়াং মুম্বাই ক্রিকেট ক্লাবে সেফ-এর চাকরি করতে গিয়ে ১৯৭৫ -এ একদিন কাস্টমারের চাহিদায় ভারতীয় মশলায়, ঐ রসুন, আদা, কাঁচা লঙ্কা আর গরম মশলার সাথে চিকেন দিয়ে তৈরী করেছিল চিকেন মাঞ্চুরিয়ান ।
-বাহ দারুণ তো কিন্তু বাড়িতে যে আমার মহিষাসুরমর্দিনীর বিগ্রহ আছে, সেই বাড়িতে মুরগির মাংস ঢোকাবো! একমাত্র মেয়ে আমার ভীষণ যত্ন করে ওকে বড় করেছি জানো, ও কি খেতে ভালোবাসে, কি জামা পরতে পছন্দ করে , কোন রঙটা ওর ভালোলাগে, হসপিটালে যখন প্রথম আমার হাতে ওকে দিল তার আগে আমি কখনো বাচ্ছা কোলে নিইনি একটা ছোট্ট পুতুলের মতো বাচ্ছা আমার দিকে চেয়ে আছে, তারপর ও প্রথম সলিড খাবার খেল, কথা বলল, আমার স্বপ্নের মতো ওকে ঘিরে সাজানো দিনগুলো কেমন হুশ করে চলে গেল ও বড় হয়ে গেল, বিয়ের সময়ও হয়ে গেল এবার ওর এই বাড়ি আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আর এই চলে যাওয়ার সময় ওর একটা ইচ্ছে রাখব না !
-কি সব বলছেন জামাইবাবু বিয়ে দিলে কি মেয়ে পর হয়ে যায় নাকি ! এখন আর এসব আছে!
চোখ ভর্তি জল নিয়ে চেয়ারে বসে থাকা চন্দনবাবুকে পিছন থেকে দুটো হাত গলা জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলল - ও বাবা! উত্তর-পূর্ব চিনের একটি অংশ মাঞ্চুরিয়া তার স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঞ্চুরিয়ান বলে। তাদের ঐ মাঞ্চু রন্ধনশৈলীতে এটা তৈরী তাই এর নাম মাঞ্চুরিয়ান।
- বাবারে! তুই তো দেখছি রিসার্চ করে ফেলেছিস। চোখের জল লুকিয়ে ফেলে বললেন চন্দনবাবু
- হ্যাঁ আমি তো জানি তোমাকে এসব বোঝাতে হবে তাই আগে থেকে একটু পড়াশোনা করে নিয়েছি। আর যাই করো আমাকে কিন্তু গৃহছাড়া করা চলবে না আমি এতদিন একটা বাড়ির দায়িত্ব নিয়েছি এখন আরেকটার নেব একটু বড় হয়ে গেছি তো তাই। তবে আমার বাবার দায়িত্ব আমি কাউকে দেব না।
স্বাস্থ্যকর খাবার খান, ভালো থাকুন।