07/08/2021
বাংলাদেশের ট্রাডিশনাল শ্বশুরবাড়িগুলোতে সাধারণত ৫ বেলা খাওয়া-দাওয়া করা হয়- ভোরের চা-বিস্কুট, সকালের ব্রেকফাস্ট, দুপুরের ভারি খাবার, বিকালের নাস্তা, সবশেষে রাতের খাবার। আর এ ধরণের বাসাগুলোতে ছেলেবউয়ের উপর প্রত্যাশা থাকে, বাড়িতে কাজ থাকুক আর না থাকুক, সমসময় চরকির মত কাজের চারপাশে ঘুরতে থাকবে- সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত রান্নাঘরকে কেন্দ্র করেই তার জীবন আবর্তিত হবে। এতেই সে বাড়ির আদর্শ বউ বলে প্রমাণিত হবে।
অথচ একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার যে, পুরুষ হোক, নারী হোক, মানুষ কোন চতুষ্পদ জন্তু নয় যার জীবন কেবল খাওয়া, ঘুম, জৈবিক চাহিদা আর সন্তান উৎপাদনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে। মানুষকে আল্লাহ একটি মিশন দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন- আল্লাহর ইবাদাত ও দাওয়াহ ইলাল্লাহ। তাই সমস্ত কাজের ফাকে হলেও তাকে এই কাজটুকুর জন্য সময় বের করতেই হবে। অন্যভাবে বললে, এই কাজগুলোকে কেন্দ্র করেই মানবজীবন আবর্তিত হবে, তার ফাকে ফাকে জগৎসংসারের অন্যান্য কাজগুলোর সময় বের করে নিতে হবে। (উল্লেখ্য, ইল্ম অর্জন করা, স্পাউজ ও সন্তানকে সময় দেয়া, সন্তানের তারবিয়াত দেয়া এগুলোও সেই মিশন পূরণের অংশ)
বিষয়টি নিয়ে দুটো প্রান্তিকতা রয়েছে- একপক্ষ মনে করে, ছেলে বিয়ে দিয়ে বউ না যেন কাজের লোক এনেছে, বাড়ির সমস্ত কাজ করার দায়িত্ব তার একার- বাড়ির মেয়ে, বাড়ির ছেলে কিংবা অন্য কারও কোন দায় নেই। বাসায় যদি কাজ নাও থাকে, তাও বউটা রান্নাঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করুক। আরেক পক্ষ মনে করে যে, শ্বশুরবাড়িতে রান্নাবান্না তার কোন দায়িত্ব না, ইসলাম তাকে এই দায়িত্ব দেয়নি, তো সে কেন তা করবে?
দুই প্রান্তিকতার মাঝে সমন্বয় প্রয়োজন- প্রথমত, ছেলেবউ কাজের লোকের সাবস্টিটিউট নয়। কিংবা সারাক্ষণ রান্নাঘরকে কেন্দ্র করেই তার জীবন আবর্তিত হবে, এটাও কোন যৌক্তিক প্রত্যাশা নয়। অন্যদিকে, যারা শ্বশুরবাড়ি ঘরের কাজ করাটাকে নিজের দায়িত্বই মনে করেন না, তারা নিজেরা আলাদা বাসায় থাকলে কি পায়ের উপর পা তুলে খেতেন? এক সংসারে যারা থাকবে, পরিবারের রান্নাবান্নাসহ সমস্ত কাজ সবারই সামষ্টিক দায়িত্ব, বউকেও সেই দায়িত্বের একটা অংশের ভাগ অবশ্যই নিতে হবে।
তবে এখানে ঝামেলাটা হয় আরেক জায়গায়, ঐ যে শুরুতেই বলেছিলাম- কাজ থাকুক না থাকুক, বউকে যেন রান্নাঘরের চারপাশে ঘুরঘুর করতেই হবে। কাজের লোক কাজ করলেও সেখানে থাকতে হবে, শাশুড়ী কাজ করলেও পাশে থাকতে হবে, বাড়ির মেয়ে করলেও ভাবীকে থাকতে হবে। অথচ এই বিষয়টা পুরোটাই 'শো অফ' যেটা করতে গিয়ে বউদের অযথা মূল্যবান সময় ও এনার্জি নষ্ট হয়, ঘরের কাজের বাইরে আর কোন প্রোডাক্টিভ কাজ করার সময় ও এনার্জি তাদের থাকেনা। এসব পরিস্থিতিতে বউদের করারও কিছু থাকেনা। এক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষেরা একটা সহজ সমাধান করতে পারেন। প্রথমত তাদেরকে এটা বুঝতে হবে যে, একটা মেয়ে বাড়ির বউ হলেও তার নিজের জন্য, তার সন্তানদের জন্য, তার ইবাদাতের জন্য, দ্বীনের কাজের জন্য দিনের কিছুটা সময় ফাকা দরকার। সংসারের দায়িত্ব নেয়া মানেই এই নয় যে সারাটা দিন তাকে কাজের উপর থেকেই নিজের বউ পদের যথার্থতা প্রমাণ করতে হবে। তাই পুরুষদের উচিৎ সংসারের কাজগুলোকে বণ্টন করে দেয়া। যে ছোটখাটো কাজগুলো পুরুষরা করতে পারেন, সেগুলোতে ফাকা সময়ে তারাও হাত লাগাবেন, স্ত্রীকে বাড়ির কাজে সাহায্য করা অমর্যাদার নয়, বরং এটাই সুন্নাহ। আর রান্নাবান্নার কাজ করার মত যদি দুজন ছেলে বউ থাকে, তাহলে দুজনের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে। যদি বউ-শাশুড়ি-ননদ থাকে, তাহলে তাদের ৩ জনের মধ্যে তাদের সুবিধা অনুযায়ী পারিবারিক কাজ ও সময় বণ্টণ করে দিতে হবে। তাতে করে যার যার স্লটের কাজ সে নিজের মত করে শেষ করে বাকি সময় রিল্যাক্স করতে পারবে। একজন কাজ করছে, বাকিরাও তার চারপাশে ভদ্রতার খাতিরে অযথা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কাজ করছে একজন, সময় নষ্ট হচ্ছে ৩ জনের; শ্বশুরবাড়ির এই 'শো অফ' প্রথার অবসান খুব জরুরি।
আর হ্যা, দিনে ৫/৬ বেলা ভুরি ভুরি রান্না আর খাওয়ার এই যে প্রচলন আমাদের সমাজে, এটা হয়তো একদিনেই বদলে ফেলা সম্ভব না। কিন্তু এটা কি আদৌ সুন্নাহ ভিত্তিক কোন জীবনব্যবস্থা? আল্লাহর রাসূলের বিবিদের ঘরে তো দিনের পর দিন চুলাও জ্বলেনি। উনার সব কিছুই সুন্নাহ মানেন, অথচ খাওয়া দাওয়ার ক্ষেত্রে কেন নয়? অতিভোজন একদিকে সুন্নাহবিরোধী কাজ, আরেকদিকে এই রান্না আর খাওয়ার আয়োজনে জীবনের যে মূল্যবান সময় ও সম্পদগুলো ব্যয়িত হচ্ছে, সেটা কি অপচয় নয়? এই আয়োজন একটু কমানো গেলে সেই সময় ও সম্পদ থেকেই অনেক প্রোডাক্টিভ ও দ্বীনি কাজ করার সময় ও সম্পদ গোছানো সম্ভব ছিলো।
জীবন তো সবার জন্য একটাই, কবরের সামানা গোছানোর সুযোগও সবার জন্য একটাই.....
(অনেকগুলো মানুষের জীবনগল্প থেকে পোস্টটি লেখা, নির্দিষ্ট কোন গল্পকে উদ্দেশ্য করে নয়)
-নিশাত তাম্মিম আপুl